ড. মো. আব্দুল মালেক১ ড. মো. আজিজুল হক২
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশিত পথে বর্তমান বাংলাদেশ সরকারের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে সময়োপযোগী বিভিন্ন পদক্ষেপের ফলে দেশ আজ দানাদার খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। ফলে দেশের মানুষকে এখন আর ক্ষুধায় না খেয়ে থাকতে হয় না। তবে চাহিদার তুলনায় ভোজ্যতেলের মোট দেশজ উৎপাদন অনেক কম হওয়ায় প্রতি বছর ঘাটতি মোকাবেলায় বিদেশ হতে ভোজ্যতেল আমদানি করতে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করে। দেশে ভোজ্যতেলের মূল উৎস হলো সরিষা এবং সামান্য পরিমাণে সূর্যমুখী, সয়াবিন ও তিল এবং রাইস ব্রান যা থেকে সর্বমোট ৫.০ লক্ষ টনের কাছাকাছি ভোজ্যতেল পাওয়া যায়। এ হিসেবে দেখা যাচ্ছে দেশের প্রয়োজনীয় ভোজ্যতেলের ঘাটতি থাকে শতকরা প্রায় ৮০ ভাগ। উল্লেখ্য, বর্তমানে দেশে আবাদি জমির মাত্র ৪.০ শতাংশ তেলফসল আবাদে ব্যবহৃত হয়। এ বাস্তবতাকে বিবেচনায় এনে আমাদের এখনই প্রয়োজন তেল ফসলের চাষাবাদ বৃদ্ধি করে তেল ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধিতে গুরুত্ব দেয়া।
বাংলাদেশের ধান নির্ভর রোপা আমন-পতিত-বোরো শস্য বিন্যাসটি দেশের বিস্তীর্ণ এলাকায় ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল। বিগত প্রায় এক দশকের ও বেশি সময় হতে দেশে স্বল্প জীবনকালের আমন ধান যেমন বিনা ধান-৭ ও ব্রি ধান-৩৩ এবং পরবর্তীতে বিনা ধান-১৬, বিনা ধান-১৭, ব্রি ধান-৭১ ও ব্রি ধান-৭৫ এবং সম্প্রতি ব্রি ধান-৯০ ও বিনাধান-২২ উদ্ভাবিত হয়েছে। স্বল্প জীবনকালের আমনের এ জাতগুলো কৃষক পর্যায়ে সম্প্রসারিত হওয়ায় রোপা আমন-পতিত-বোরো শস্য বিন্যাসে স্বল্প জীবনকালের আমন ধান সংগ্রহের পর স্বল্প জীবনকালের অথচ উচ্চফলনশীল সরিষা জাত বিনা সরিষা-৪, বিনা সরিষা-৯ ও বিনা সরিষা-১০, বারি সরিষা- ১৪, বারি সরিষা- ১৫ এবং বারি সরিষা-১৭ চাষ করা হচ্ছে ফলে প্রচলিত আমন ধান-পতিত-বোরো ধান শস্য বিন্যাসটি পর্যায়ক্রমে রোপা আমন-সরিষা-বোরো শস্যবিন্যাসে রূপান্তরিত হচ্ছে। প্রচলিত শস্য বিন্যাসটিকে সম্পূর্ণ রূপে রোপা আমন-সরিষা-বোরো ধান শস্য বিন্যাসে রূপান্তরিত করতে হলে বাস্তবতার নিরিখে সরিষা চাষাবাদ পদ্ধতিতে কিছু পরিবর্তন আনতে হবে। দেশে বর্তমানে চাষকৃত স্বল্প জীবন কালের রোপা আমন ধানের জাতসমূহ সংগ্রহের পর প্রচলিত পদ্ধতিতে জমি প্রস্তুত সরিষা চাষ করতে হলে জমি সম্পূর্ণ জো অবস্থায় আসার পর ভালোভাবে শুকিয়ে বীজ বপন করতে হয়, কারণ জো অবস্থায় আসার আগেই জমি চাষ দিলে এবং মাটির বেশি আর্দ্রতায় বীজ বপন করলে অংকুরোদগম ঠিকভাবে হলেও পরবর্তীতে সবিষার বৃদ্ধি খুবই ধীর গতিতে হয়। অপেক্ষাকৃত উঁচু জমিতে এ পদ্ধতিতে সরিষা চাষ করা সম্ভব হলেও নিচু এবং ভারি বুনটের মাটিতে আমন ধান সংগ্রহের পর মাটির আর্দ্রতা বেশি থাকায় জমিতে জো আসার পর চাষ দিয়ে সরিষা আবাদ করতে গেলে বিলম্ব হয় বিধায় সরিষা চাষ করা সম্ভব হয় না। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে দেরিতে বপন করে সরিষা আবাদ করা সম্ভব হলেও আশানুরূপ ফলন পাওয়া যায় না এবং পরবর্তী বোরো ধান চাষের ক্ষেত্রেও চারা দেরিতে রোপণ করতে হয় বিধায় বোরো ধানের ফলন কমে যাওয়াসহ সংগ্রহের সময় ঝড়-বৃষ্টির প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় ফলন হ্রাসের ঝুঁকি আরও বেড়ে যায়। ফলশ্রæতিতে কৃষকগণ আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাছাড়া বিগত কয়েক বছরে আমন ধান সংগ্রহকালীন পরিবর্তিত আবওহাওয়াজনিত কারণে ভারী বৃষ্টিপাতের ফলে মাটির আর্দ্রতা প্রায় শতভাগ পর্যন্ত পৌঁছে যায়, ফলে চাষ দিয়ে সরিষা আবাদ করা সম্ভব হয়ে উঠে না বিধায় জমি পতিত রাখতে হয়। তাছাড়া দেশের বরিশাল অঞ্চলের কিছু এলাকাসহ অন্যান্য অঞ্চলে প্রচলিত রোপা আমন-পতিত-পতিত শস্যবিন্যাসে রোপা আমন সংগ্রহ পরবর্তী পতিত জমি এবং বিশেষ করে হাওর অঞ্চলের বোরো-পতিত-পতিত শস্য বিন্যাসে বোরো ধান চাষের পূর্বে পতিত জমিতে শূন্য চাষ পদ্ধতিতে সরিষা চাষের সুযোগ আছে। উল্লিখিত সমস্যা হতে উত্তরণ কল্পে রোপা আমন ধান সংগ্রহের পর এবং বোরো ধান চাষের পূর্বে বিনা চাষে সরিষা চাষের বিষয়টি বিশেষ গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় আনা প্রয়োজন।
এ পদ্ধতিতে সরিষা চাষ দেশে সরিষার উৎপাদন বৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখার পাশাপাশি দেশে ভোজ্যতেলের আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করা সম্ভব। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বুরো (বিবিএস) এর তথ্যে দেখা যায় গত ২০১৮ সালে দেশে ৪৬.২১ লক্ষ টন ভোজ্যতেল আমদানিতে ২৭.৭৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয় কর হয়েছে, যদিও আমদানিকৃত তেলের বড় একটি অংশ শিল্প কারখানায় ব্যবহৃত হয়। দেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা এবং খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের ফলে দেশে ভোজ্যতেলের চাহিদা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওযায় বিগত কয়েক বছরে এই আমদানিহার পূর্ববর্তী বছরগুলোর তুলনায় আশংকাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। মাথাপিছু দৈনিক ৪০ গ্রাম হারে ভোজ্যতেল প্রয়োজন হলে ২০২১ সালে দেশে ভোজ্যতেলের মোটচাহিদা হবে প্রায় ২৫.০ লক্ষ মেট্রিক টন।
আমরা জানি সরিষার ফলন রাসায়নিক সারে বেশ সাড়া দেয়। তাই শূন্য চাষ পদ্ধতির মাধমে সরিষা চাষে সারের বিভিন্ন মাত্রার প্রভাব পর্যবেক্ষণে বিনা উপকেন্দ্র মাঠ, ঈশ্বরদী, পাবনায় বিনা উদ্ভাবিত উচ্চফলনশীল ও স্বল্প জীবনকালের সরিষার জাত বিনা সরিষা-৯ ব্যবহার করে একটি পরীক্ষণ সম্পন্ন করা হয়। উল্লেখ্য পরীক্ষণটি ৫ ডিসেম্বর ২০১৮ তারিখে স্থাপন করা হয়েছিল, যা সরিষা বপনের উপযুক্ত সময়ের এক মাস পর। পরীক্ষণটিতে রাসায়নিক সারের বিভিন্ন কম্বিনেশনের ফলাফলে দেখা যায় যে, সুপারিশকৃত সকল রাসায়নিক সারের ১০০% প্রয়োগে ১১১৭ কেজি/হে. ফলন পাওয়া যায়। উল্লেখ্য বিলম্বে অর্থাৎ সঠিক সময়ের চেয়ে একমাস পরে বপনজনিত কারণে ফলন আশানুরূপ হয়নি।
উক্ত ফলাফলদ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, শূন্য চাষ পদ্ধতিতে সরিষা আবাদে সুষম মাত্রার সার প্রয়োগের মাধ্যমে ফলন বৃদ্ধিসহ সরিষার দেশীয় মোট উৎপাদন অনেকাংশে বৃদ্ধি করা সম্ভব। উপযুক্ত সময়ের চেয়ে প্রায় একমাস পরে বপনজনিত কারণে আশানুরূপ ফলন পাওয়া যায়নি। উপরোল্লিখিত বিষয়গুলো বিবেচনায় এনে ২০১৯-২০ মৌসুমে নভেম্বর মাসের প্রথম হতে দ্বিতীয় সপ্তাহের মধ্যে চাষবিহীন জমিতে বীজ বপন করে বিনা প্রধান কার্যালয় খামার এবং উপকেন্দ্র ঈশ্বরদী, মাগুরা, কুমিল্লা ও সাতক্ষীরার মাধ্যমে উপকেন্দ্র গবেষণা মাঠ এবং কৃষকের মাঠে সুপারিশকৃত সকল রাসায়নিক সারের ১০০% তবে ধীরগতিতে দ্রবণশীলটি এসপি’র পরিবর্তে অধিকতর দ্রæত দ্রবনশীল ডিএপি প্রয়োগের মাধ্যমে জাতটি চাষ করে হেক্টরপ্রতি গড়ে ১৪৩০ কেজি ফলন পাওয়া যায়।
শূন্য চাষ পদ্ধতিতে সার ও সেচ প্রয়োগ : এ পদ্ধতিতে সরিষা আবাদের ক্ষেত্রে ইউরিয়া সারের এক তৃতীয়াংশ (একরপ্রতি ২০ কেজি) এবং অন্যান্য রাসায়নিক সারের পুরোটাই (একর ডিএপি ৭৫ কেজি, এমওপি ৫০ কেজি, জিপসাম ৫৫ কেজি, জিংকসালফেট ৪ কেজি এবং বোরিক এসিড ৩ কেজি) একত্রে জমিতে প্রয়োগ করে পরে বীজ বপন করতে হবে এবং ইউরিয়ার এক তৃতীয়াংশ (একর প্রতি ২০ কেজি) বীজ বপনের ১৫ দিন পর আর অবশিষ্ট এক তৃতীয়াংশ ইউরিয়া (একর প্রতি ২০ কেজি) ফুল আসা পর্যায়ে উপরি প্রয়োগ করতে হবে। উল্লেখ্য, শূন্য চাষ পদ্ধতিতে টিএসপির পরিবর্তে ডিএপি ব্যবহার করতে হবে, কারণ টিএসপির তুলনায় ডিএপি দ্রæত দ্রবনশীল। তাছাড়া এ পদ্ধতিতে সরিষা আবাদের ক্ষেত্রে ফলনে পানি সেচ ও বিশেষ ভ‚মিকা রাখে তাই হালকা বুনটজনিত কারণে মাটিতে রসের অভাব হলে অঙ্গজ বৃদ্ধি পর্যায় ও ফুল আসার সময় সেচ প্রয়োগ করতে হবে।
বীজ হার, বপন সময় ও জমি নির্বাচন : একর প্রতি ৩ কেজি বীজ ব্যবহার করতে হবে। ভাল ফলন পেতে হলে উপযুক্ত সময়ে অর্থাৎ কার্তিক মাসের ২য় সপ্তাহ হতে শেষ পর্যন্ত (অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ হতে মধ্য নভেম্বর) বীজ বপন করতে হবে। তবে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের বরিশাল ও খুলনা অঞ্চলের নিচু জমিতে আমন ধান দেরিতে রোপণজনিত কারণে দেরিতে সংগ্রহ হয় বিধায় দুইটি অঞ্চলে জানুয়ারি মাসের ১ম সপ্তাহ পর্যন্ত নাবিতে বপনযোগ্য বিনা সরিষা-৪ ও বিনা সরিষা-৯ এর বীজ বপন করা যাবে। আরও বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে যেসব এলাকায় আমন ধান কাটার পর জমিতে পর্যাপ্ত রস থাকে অর্থাৎ জমিতে হাটলে মাটিতে পায়ের ছাপ পড়ে এমন জমিতে শূন্য চাষে সরিষা আবাদ করতে হবে। তাছাড়া আমন ধান সংগ্রহের পর জমিতে আগাছার উপদ্রব হয় না বা তুলনামূলকভাবে কম হয় এমন জমি নির্বাচন করতে হবে।
বাণিজ্যিক কৃষিতে প্রভাব : বর্তমান বাণিজ্যিক কৃষিতে শস্যবিন্যাসে ফসলসহ এমন চাষাবাদ পদ্ধতি নির্বাচন করতে হবে যাতে ফসল চাষে লাভ তুলনামূলকভাবে বেশি আসে। এক্ষেত্রে রোপা আমন - পতিত - বোরো শস্য বিন্যাসে শূন্য চাষ পদ্ধতিতে রোপা আমন এবং বোরো ধানের মধ্যবর্তী সময়ে খুবই কম খরচে সরিষা আবাদ করে কৃষকগণ লাভবান হতে পারেন। কারণ এ পদ্ধতিতে সরিষা আবাদে খরচ তুলনামূলকভাবে কম হয়।এ পদ্ধতিতে সরিষা আবাদে একর প্রতি রাসায়নিক সার প্রয়োগ, প্রয়োজনে একটি সেচ দেয়া এবং পাতা ও ফলের অল্টারনারিয়া বøাইট রোগ ও জাবপোকা দমনে বালাইনাশক প্রয়োগ এবং সরিষা সংগ্রহ ও মাড়াই বাবদ আনুমানিক ১৩ হতে ১৪ হাজার টাকা খরচ হতে পারে। একরপ্রতি গড়ে ১২ মণ সরিষার ফলন প্রাপ্তিতে আয় হতে পারে প্রায় ২৪ হাজার টাকা। অর্থাৎ বিনাচাষ পদ্ধতিতে সরিষা আবাদ করে উৎপাদন খরচ বাদে একরপ্রতি প্রায় ১১ হাজার টাকা পর্যন্ত লাভ করা সম্ভব।
বিনা চাষে সরিষা আবাদের মাধ্যমে দেশীয় সরিষার উৎপাদন তথা ফলন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে দেশের বিভিন্ন কৃষি পরিবেশ অঞ্চলে রাসায়নিক সার ও সেচ প্রয়োগ এবং বিভিন্ন আন্তঃপরিচর্যা বিষয়ে মাঠপর্যায়ে আরও ব্যাপক গবেষণার প্রয়োজন। শূন্য চাষ পদ্ধতিতে সরিষা চাষ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কৃষকদেরকে উদ্বুদ্ধ করতে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাঠ পর্যায়ে কর্মকর্তাগণকে বিশেষ ভ‚মিকা পালনসহ সংশ্লিষ্ট সরিষা চাষাধীন এলাকায় কৃষক প্রশিক্ষণ ও উপকরণ সরবরাহের মাধ্যমে ব্যাপকভাবে মাঠ প্রদর্শনী স্থাপনসহ মাঠ দিবসের আয়োজন করতে হবে।
মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, ২প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, ময়মনসিংহ-২২০২ মোবাইল: ০১৭১২১০৬৬২০, ইমেইল: malekbina@gmail.com
ড. মো. আব্দুল মালেক১ ড. মো. আজিজুল হক২
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশিত পথে বর্তমান বাংলাদেশ সরকারের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে সময়োপযোগী বিভিন্ন পদক্ষেপের ফলে দেশ আজ দানাদার খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। ফলে দেশের মানুষকে এখন আর ক্ষুধায় না খেয়ে থাকতে হয় না। তবে চাহিদার তুলনায় ভোজ্যতেলের মোট দেশজ উৎপাদন অনেক কম হওয়ায় প্রতি বছর ঘাটতি মোকাবেলায় বিদেশ হতে ভোজ্যতেল আমদানি করতে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করে। দেশে ভোজ্যতেলের মূল উৎস হলো সরিষা এবং সামান্য পরিমাণে সূর্যমুখী, সয়াবিন ও তিল এবং রাইস ব্রান যা থেকে সর্বমোট ৫.০ লক্ষ টনের কাছাকাছি ভোজ্যতেল পাওয়া যায়। এ হিসেবে দেখা যাচ্ছে দেশের প্রয়োজনীয় ভোজ্যতেলের ঘাটতি থাকে শতকরা প্রায় ৮০ ভাগ। উল্লেখ্য, বর্তমানে দেশে আবাদি জমির মাত্র ৪.০ শতাংশ তেলফসল আবাদে ব্যবহৃত হয়। এ বাস্তবতাকে বিবেচনায় এনে আমাদের এখনই প্রয়োজন তেল ফসলের চাষাবাদ বৃদ্ধি করে তেল ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধিতে গুরুত্ব দেয়া।
বাংলাদেশের ধান নির্ভর রোপা আমন-পতিত-বোরো শস্য বিন্যাসটি দেশের বিস্তীর্ণ এলাকায় ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল। বিগত প্রায় এক দশকের ও বেশি সময় হতে দেশে স্বল্প জীবনকালের আমন ধান যেমন বিনা ধান-৭ ও ব্রি ধান-৩৩ এবং পরবর্তীতে বিনা ধান-১৬, বিনা ধান-১৭, ব্রি ধান-৭১ ও ব্রি ধান-৭৫ এবং সম্প্রতি ব্রি ধান-৯০ ও বিনাধান-২২ উদ্ভাবিত হয়েছে। স্বল্প জীবনকালের আমনের এ জাতগুলো কৃষক পর্যায়ে সম্প্রসারিত হওয়ায় রোপা আমন-পতিত-বোরো শস্য বিন্যাসে স্বল্প জীবনকালের আমন ধান সংগ্রহের পর স্বল্প জীবনকালের অথচ উচ্চফলনশীল সরিষা জাত বিনা সরিষা-৪, বিনা সরিষা-৯ ও বিনা সরিষা-১০, বারি সরিষা- ১৪, বারি সরিষা- ১৫ এবং বারি সরিষা-১৭ চাষ করা হচ্ছে ফলে প্রচলিত আমন ধান-পতিত-বোরো ধান শস্য বিন্যাসটি পর্যায়ক্রমে রোপা আমন-সরিষা-বোরো শস্যবিন্যাসে রূপান্তরিত হচ্ছে। প্রচলিত শস্য বিন্যাসটিকে সম্পূর্ণ রূপে রোপা আমন-সরিষা-বোরো ধান শস্য বিন্যাসে রূপান্তরিত করতে হলে বাস্তবতার নিরিখে সরিষা চাষাবাদ পদ্ধতিতে কিছু পরিবর্তন আনতে হবে। দেশে বর্তমানে চাষকৃত স্বল্প জীবন কালের রোপা আমন ধানের জাতসমূহ সংগ্রহের পর প্রচলিত পদ্ধতিতে জমি প্রস্তুত সরিষা চাষ করতে হলে জমি সম্পূর্ণ জো অবস্থায় আসার পর ভালোভাবে শুকিয়ে বীজ বপন করতে হয়, কারণ জো অবস্থায় আসার আগেই জমি চাষ দিলে এবং মাটির বেশি আর্দ্রতায় বীজ বপন করলে অংকুরোদগম ঠিকভাবে হলেও পরবর্তীতে সবিষার বৃদ্ধি খুবই ধীর গতিতে হয়। অপেক্ষাকৃত উঁচু জমিতে এ পদ্ধতিতে সরিষা চাষ করা সম্ভব হলেও নিচু এবং ভারি বুনটের মাটিতে আমন ধান সংগ্রহের পর মাটির আর্দ্রতা বেশি থাকায় জমিতে জো আসার পর চাষ দিয়ে সরিষা আবাদ করতে গেলে বিলম্ব হয় বিধায় সরিষা চাষ করা সম্ভব হয় না। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে দেরিতে বপন করে সরিষা আবাদ করা সম্ভব হলেও আশানুরূপ ফলন পাওয়া যায় না এবং পরবর্তী বোরো ধান চাষের ক্ষেত্রেও চারা দেরিতে রোপণ করতে হয় বিধায় বোরো ধানের ফলন কমে যাওয়াসহ সংগ্রহের সময় ঝড়-বৃষ্টির প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় ফলন হ্রাসের ঝুঁকি আরও বেড়ে যায়। ফলশ্রæতিতে কৃষকগণ আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাছাড়া বিগত কয়েক বছরে আমন ধান সংগ্রহকালীন পরিবর্তিত আবওহাওয়াজনিত কারণে ভারী বৃষ্টিপাতের ফলে মাটির আর্দ্রতা প্রায় শতভাগ পর্যন্ত পৌঁছে যায়, ফলে চাষ দিয়ে সরিষা আবাদ করা সম্ভব হয়ে উঠে না বিধায় জমি পতিত রাখতে হয়। তাছাড়া দেশের বরিশাল অঞ্চলের কিছু এলাকাসহ অন্যান্য অঞ্চলে প্রচলিত রোপা আমন-পতিত-পতিত শস্যবিন্যাসে রোপা আমন সংগ্রহ পরবর্তী পতিত জমি এবং বিশেষ করে হাওর অঞ্চলের বোরো-পতিত-পতিত শস্য বিন্যাসে বোরো ধান চাষের পূর্বে পতিত জমিতে শূন্য চাষ পদ্ধতিতে সরিষা চাষের সুযোগ আছে। উল্লিখিত সমস্যা হতে উত্তরণ কল্পে রোপা আমন ধান সংগ্রহের পর এবং বোরো ধান চাষের পূর্বে বিনা চাষে সরিষা চাষের বিষয়টি বিশেষ গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় আনা প্রয়োজন।
এ পদ্ধতিতে সরিষা চাষ দেশে সরিষার উৎপাদন বৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখার পাশাপাশি দেশে ভোজ্যতেলের আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করা সম্ভব। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বুরো (বিবিএস) এর তথ্যে দেখা যায় গত ২০১৮ সালে দেশে ৪৬.২১ লক্ষ টন ভোজ্যতেল আমদানিতে ২৭.৭৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয় কর হয়েছে, যদিও আমদানিকৃত তেলের বড় একটি অংশ শিল্প কারখানায় ব্যবহৃত হয়। দেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা এবং খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের ফলে দেশে ভোজ্যতেলের চাহিদা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওযায় বিগত কয়েক বছরে এই আমদানিহার পূর্ববর্তী বছরগুলোর তুলনায় আশংকাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। মাথাপিছু দৈনিক ৪০ গ্রাম হারে ভোজ্যতেল প্রয়োজন হলে ২০২১ সালে দেশে ভোজ্যতেলের মোটচাহিদা হবে প্রায় ২৫.০ লক্ষ মেট্রিক টন।
আমরা জানি সরিষার ফলন রাসায়নিক সারে বেশ সাড়া দেয়। তাই শূন্য চাষ পদ্ধতির মাধমে সরিষা চাষে সারের বিভিন্ন মাত্রার প্রভাব পর্যবেক্ষণে বিনা উপকেন্দ্র মাঠ, ঈশ্বরদী, পাবনায় বিনা উদ্ভাবিত উচ্চফলনশীল ও স্বল্প জীবনকালের সরিষার জাত বিনা সরিষা-৯ ব্যবহার করে একটি পরীক্ষণ সম্পন্ন করা হয়। উল্লেখ্য পরীক্ষণটি ৫ ডিসেম্বর ২০১৮ তারিখে স্থাপন করা হয়েছিল, যা সরিষা বপনের উপযুক্ত সময়ের এক মাস পর। পরীক্ষণটিতে রাসায়নিক সারের বিভিন্ন কম্বিনেশনের ফলাফলে দেখা যায় যে, সুপারিশকৃত সকল রাসায়নিক সারের ১০০% প্রয়োগে ১১১৭ কেজি/হে. ফলন পাওয়া যায়। উল্লেখ্য বিলম্বে অর্থাৎ সঠিক সময়ের চেয়ে একমাস পরে বপনজনিত কারণে ফলন আশানুরূপ হয়নি।
উক্ত ফলাফলদ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, শূন্য চাষ পদ্ধতিতে সরিষা আবাদে সুষম মাত্রার সার প্রয়োগের মাধ্যমে ফলন বৃদ্ধিসহ সরিষার দেশীয় মোট উৎপাদন অনেকাংশে বৃদ্ধি করা সম্ভব। উপযুক্ত সময়ের চেয়ে প্রায় একমাস পরে বপনজনিত কারণে আশানুরূপ ফলন পাওয়া যায়নি। উপরোল্লিখিত বিষয়গুলো বিবেচনায় এনে ২০১৯-২০ মৌসুমে নভেম্বর মাসের প্রথম হতে দ্বিতীয় সপ্তাহের মধ্যে চাষবিহীন জমিতে বীজ বপন করে বিনা প্রধান কার্যালয় খামার এবং উপকেন্দ্র ঈশ্বরদী, মাগুরা, কুমিল্লা ও সাতক্ষীরার মাধ্যমে উপকেন্দ্র গবেষণা মাঠ এবং কৃষকের মাঠে সুপারিশকৃত সকল রাসায়নিক সারের ১০০% তবে ধীরগতিতে দ্রবণশীলটি এসপি’র পরিবর্তে অধিকতর দ্রæত দ্রবনশীল ডিএপি প্রয়োগের মাধ্যমে জাতটি চাষ করে হেক্টরপ্রতি গড়ে ১৪৩০ কেজি ফলন পাওয়া যায়।
শূন্য চাষ পদ্ধতিতে সার ও সেচ প্রয়োগ : এ পদ্ধতিতে সরিষা আবাদের ক্ষেত্রে ইউরিয়া সারের এক তৃতীয়াংশ (একরপ্রতি ২০ কেজি) এবং অন্যান্য রাসায়নিক সারের পুরোটাই (একর ডিএপি ৭৫ কেজি, এমওপি ৫০ কেজি, জিপসাম ৫৫ কেজি, জিংকসালফেট ৪ কেজি এবং বোরিক এসিড ৩ কেজি) একত্রে জমিতে প্রয়োগ করে পরে বীজ বপন করতে হবে এবং ইউরিয়ার এক তৃতীয়াংশ (একর প্রতি ২০ কেজি) বীজ বপনের ১৫ দিন পর আর অবশিষ্ট এক তৃতীয়াংশ ইউরিয়া (একর প্রতি ২০ কেজি) ফুল আসা পর্যায়ে উপরি প্রয়োগ করতে হবে। উল্লেখ্য, শূন্য চাষ পদ্ধতিতে টিএসপির পরিবর্তে ডিএপি ব্যবহার করতে হবে, কারণ টিএসপির তুলনায় ডিএপি দ্রæত দ্রবনশীল। তাছাড়া এ পদ্ধতিতে সরিষা আবাদের ক্ষেত্রে ফলনে পানি সেচ ও বিশেষ ভ‚মিকা রাখে তাই হালকা বুনটজনিত কারণে মাটিতে রসের অভাব হলে অঙ্গজ বৃদ্ধি পর্যায় ও ফুল আসার সময় সেচ প্রয়োগ করতে হবে।
বীজ হার, বপন সময় ও জমি নির্বাচন : একর প্রতি ৩ কেজি বীজ ব্যবহার করতে হবে। ভাল ফলন পেতে হলে উপযুক্ত সময়ে অর্থাৎ কার্তিক মাসের ২য় সপ্তাহ হতে শেষ পর্যন্ত (অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ হতে মধ্য নভেম্বর) বীজ বপন করতে হবে। তবে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের বরিশাল ও খুলনা অঞ্চলের নিচু জমিতে আমন ধান দেরিতে রোপণজনিত কারণে দেরিতে সংগ্রহ হয় বিধায় দুইটি অঞ্চলে জানুয়ারি মাসের ১ম সপ্তাহ পর্যন্ত নাবিতে বপনযোগ্য বিনা সরিষা-৪ ও বিনা সরিষা-৯ এর বীজ বপন করা যাবে। আরও বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে যেসব এলাকায় আমন ধান কাটার পর জমিতে পর্যাপ্ত রস থাকে অর্থাৎ জমিতে হাটলে মাটিতে পায়ের ছাপ পড়ে এমন জমিতে শূন্য চাষে সরিষা আবাদ করতে হবে। তাছাড়া আমন ধান সংগ্রহের পর জমিতে আগাছার উপদ্রব হয় না বা তুলনামূলকভাবে কম হয় এমন জমি নির্বাচন করতে হবে।
বাণিজ্যিক কৃষিতে প্রভাব : বর্তমান বাণিজ্যিক কৃষিতে শস্যবিন্যাসে ফসলসহ এমন চাষাবাদ পদ্ধতি নির্বাচন করতে হবে যাতে ফসল চাষে লাভ তুলনামূলকভাবে বেশি আসে। এক্ষেত্রে রোপা আমন - পতিত - বোরো শস্য বিন্যাসে শূন্য চাষ পদ্ধতিতে রোপা আমন এবং বোরো ধানের মধ্যবর্তী সময়ে খুবই কম খরচে সরিষা আবাদ করে কৃষকগণ লাভবান হতে পারেন। কারণ এ পদ্ধতিতে সরিষা আবাদে খরচ তুলনামূলকভাবে কম হয়।এ পদ্ধতিতে সরিষা আবাদে একর প্রতি রাসায়নিক সার প্রয়োগ, প্রয়োজনে একটি সেচ দেয়া এবং পাতা ও ফলের অল্টারনারিয়া বøাইট রোগ ও জাবপোকা দমনে বালাইনাশক প্রয়োগ এবং সরিষা সংগ্রহ ও মাড়াই বাবদ আনুমানিক ১৩ হতে ১৪ হাজার টাকা খরচ হতে পারে। একরপ্রতি গড়ে ১২ মণ সরিষার ফলন প্রাপ্তিতে আয় হতে পারে প্রায় ২৪ হাজার টাকা। অর্থাৎ বিনাচাষ পদ্ধতিতে সরিষা আবাদ করে উৎপাদন খরচ বাদে একরপ্রতি প্রায় ১১ হাজার টাকা পর্যন্ত লাভ করা সম্ভব।
বিনা চাষে সরিষা আবাদের মাধ্যমে দেশীয় সরিষার উৎপাদন তথা ফলন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে দেশের বিভিন্ন কৃষি পরিবেশ অঞ্চলে রাসায়নিক সার ও সেচ প্রয়োগ এবং বিভিন্ন আন্তঃপরিচর্যা বিষয়ে মাঠপর্যায়ে আরও ব্যাপক গবেষণার প্রয়োজন। শূন্য চাষ পদ্ধতিতে সরিষা চাষ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কৃষকদেরকে উদ্বুদ্ধ করতে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাঠ পর্যায়ে কর্মকর্তাগণকে বিশেষ ভ‚মিকা পালনসহ সংশ্লিষ্ট সরিষা চাষাধীন এলাকায় কৃষক প্রশিক্ষণ ও উপকরণ সরবরাহের মাধ্যমে ব্যাপকভাবে মাঠ প্রদর্শনী স্থাপনসহ মাঠ দিবসের আয়োজন করতে হবে।
মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, ২প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, ময়মনসিংহ-২২০২ মোবাইল: ০১৭১২১০৬৬২০, ইমেইল: malekbina@gmail.com